নিজস্ব প্রতিবেদন, বাংলা কাগজ : দেশের উন্নয়ন যেন কিছুটা হলেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বন্যা। অথচ এ ধরনের ক্ষেত্রে দোষী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশ্লিষ্ট এলাকার কর্মকর্তারা। তাঁদের সঙ্গে অন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সাংসদ-মন্ত্রীরাও দায় এড়াতে পারেন না। কারণ দেশের বিভিন্ন নদীর বাঁধগুলো কিছুদিন পরপরই ভেঙ্গে যাচ্ছে। ফলে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পরও এখনও আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় বন্যা। এমন অবস্থায় বন্যা দুর্গতদের জন্য যেন আসছে ইদ রূপ নিয়েছে এক বিষাদে।
জানা গেছে- দেশজুড়ে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে বন্যা। আবার এবার আবহাওয়া অফিসের কোনও পূর্বাভাসই যেন কাজে লাগে নি। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আগাম বন্যা। এতে ব্যাপক অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ।
বাংলা কাগজের সংবাদদাতাদের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে- এখনও দেশের মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। আর বন্যাকবলিত হয়ে দুর্ভোগে রয়েছেন পানিবন্দিরা। দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। এরসঙ্গে আরও একটি বিষয় নিয়ে লড়তে হচ্ছে তাঁদের- যেটি হচ্ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ।
জানা গেছে- ইতোমধ্যে বেশকিছু বাঁধ ভেঙে গেছে দেশজুড়ে। বাঁধ ভাঙার এমন অংশ হিসেবে এবার ভাঙলো ফরিদপুর সদর উপজেলার আলিয়াবাদ ইউনিয়নের শহর রক্ষা বাঁধ। বাঁধটি শহরতলীর সাদিপুর ও বায়তুলআমান সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এদিকে, পদ্মার পানি এখনও বিপদসীমার ১০৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আর ফাটল দেখা দেওয়ায় ফরিদপুর চরভদ্রাসন আঞ্চলিক সড়কে যান চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই সড়কের বেশ কয়েকটি স্থান পদ্মার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ফাটলের স্থানে জিও ব্যাগ ফেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
জানা গেছে- দেশের অন্য এলাকার চেয়ে ফরিদপুরে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বাংলা কাগজকে জানান, জেলার ৩০টি ইউনিয়নে ২২ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি রয়েছে। তাঁদের জন্য ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে সরকারি খাদ্য সহায়তা। এছাড়া জেলা সদর থেকে চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলার প্রধান সড়কটি চলাচলের উপযোগী করতে সড়ক বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ জানান, বর্তমানে পদ্মার পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ৯ দশমিক ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপদসীমার ১০৪ সেন্টিমিটার উপরে। এর ফলে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। তিনি জানান, শহর বন্যা প্রতিরক্ষা বাধের আলিয়াবাদে প্রায় ১০০ ফিটের মত জায়গা ধসে গেছে।
এদিকে মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মুন্সীগঞ্জের ৪টি উপজেলার নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর প্রায় কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পদ্মার ভাঙনে টঙ্গীবাড়ি ও লৌহজং উপজেলার বিস্তৃর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মার পানি আরো বৃদ্ধি পেয়ে ভাগ্যকুল ও মাওয়ায় বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছে। আরও একাধিক গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
এ এলাকায় সরকারি হিসাবে ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি থাকার তথ্য থাকলেও বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি। আগামী দুই দিন গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া।
মুন্সীগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুস বুলবুল জানান- বন্যা কবলিত পরিবারে জন্য এ পর্যন্ত ৪৫ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং নগদ আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে জামালপুর, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়াসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বাড়িঘর থেকে এখনও পানি না নামায় দুর্ভোগে রয়েছে বানভাসী মানুষ।
যমুনার পানি কমলেও জামালপুরের সাত উপজেলায় প্রায় ৯ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এখনো বাড়িঘরে কোমর ও হাঁটুপানি। গত একমাস ধরে অনেকেই উঁচু রাস্তা, ব্রিজ এবং সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছেন।
বগুড়ার ধুনট সারিয়াকান্দি এবং সোনাতলা উপজেলার নিম্ন ও মধ্য অঞ্চলগুলো প্লাবিত থাকায় দু’শোটি গ্রামের প্রায় দেড়লাখ মানুষ বন্যাকবলিত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোর স্বাস্থ্যসেবা, খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ গো-খাদ্যের অভাবে দুর্ভোগ বাড়ছে। সিরাজগঞ্জের অবস্থাও একই।
টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৮ সেন্টিমিটার কমে বর্তমানে বিপদসীমার ৮৩ সে.মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে এখনও নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। জেলায় প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেকে বাড়ি ঘর ছেড়ে রাস্তার পাশে উঁচু জায়গায় স্থান নিয়েছেন। এসব মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ এসব বানভাসী মানুষদের।
বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্ভোগ বেড়েছে বানভাসি মানুষদের। বাড়িতে পানি, ভেসে গেছে বির্স্তীণ এলাকার ফসলি জমি, পুকুরের মাছ। ২য় দফার বন্যা পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভূঞাপুর, কালিহাতি, টাঙ্গাইল সদর দেলদুয়ার ও নাগরপুর উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নের ১৯৬টি গ্রামের ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।
অনেকেই গরু ছাগল হাঁস মুরগি নিয়ে রাস্তার পাশে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিলেও চরম খাদ্য সংকটে পরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ত্রাণ সহায়তার দাবি জানিয়েছেন বানভাসিরা।
এদিককে, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর বন্যাকবলিত এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির উদ্যোগে ৫ হাজার বন্যাকবলিত মানুষের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। দুপুরে উপজেলার গোবিন্দাসী এলাকায় এই ত্রাণ সামগ্রী বিতরন করেছেন তিনি। এসময় সাংসদ তানভীর হাসান ছোট মনি বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারো মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে। এতে অনেক মানুষ গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসব মানুষ যাতে না খেয়ে কষ্ট না পায় সেই লক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
নাটোরের সিংড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে করে সিংড়া উপজেলার শেরকোল, কলম, তাজপুর ইউনিয়ন ও সিংড়া পৌরসভার ৫শ’ বাড়িতে পুনরায় নতুন করে পানি প্রবেশ করেছে। অপরদিকে বারনই নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। রোববার (১৯ জুলাই) জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।