নিজস্ব প্রতিবেদন, বাংলা কাগজ : আইন-কানুন রীতিনীতি যেনো ‘কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’। এমনই অবস্থা হয়েছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বিকাশের ক্ষেত্রে।
প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের তো ‘বৃদ্ধাঙুলি দেখাচ্ছেই’, ‘বৃদ্ধাঙুলি দেখাচ্ছে’ খোদ বাংলাদেশ ব্যাংককেও। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়িই, যেমন গ্রাহকেরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন; তেমনি সৃষ্টি ‘করা হচ্ছে’ সন্দেহজনক লেনদেনের সুযোগও (শঙ্কা)।
আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘দিস ইজ ঠু মাচ।’
এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকও অবশ্য বলছে, নির্দেশনা অমান্য করা হলো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি বলছে, ২০১৩ সালে পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ (পিএসডি) থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পিএসডি সার্কুলার লেটার নম্বর : ০১/২০১৩ এর ৩ নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়েছিলো : ‘গ্রাহকের মোবাইল হিসাব থাকার বিষয়টি এজেন্ট কর্তৃক নিশ্চিত হয়ে প্রয়োজনীয় লেনদেন করতে হবে। এক্ষেত্রে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট এজেন্ট/এজেন্টদের এজেন্সিশিপ তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করতে হবে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও নজরদারিতে থাকবে।’
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা কাগজকে বলেন, ‘মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যে কোনও হিসাব খোলার ক্ষেত্রে কেওয়াইসি (আপনার গ্রাহককে জানুন) সংক্রান্ত কিছু তথ্যের প্রয়োজন পড়ে। তাই এজেন্ট লেনদেন করার সময় যদি নিশ্চিত হয়ে নেয় ওই ব্যক্তির হিসাব আছে কি-না, তাহলে কোনও অনিয়মের সম্ভাবনা থাকে না।’
‘কিন্তু এজেন্ট যদি গ্রাহকের নম্বর লিখে না রাখে এবং নিশ্চিত না হয়, তাহলে অন্য ধরনের লেনদেন (সন্দেহজনক লেনদেন) হলেও ধরার উপায় থাকবে না।’
‘এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবশ্যই তদারকি জোরদার করতে হবে। কিন্তু এটি আরও আগে থেকেই করা উচিত ছিলো।’
একই প্রজ্ঞাপনের ৪ নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়েছে ‘এক এজেন্ট এর মোবাইল হিসাব থেকে অন্য এজেন্ট এর মোবাইল হিসাব-এ অর্থ জমা (Cash In) বা অর্থ স্থানান্তর (P2P) করা যাবে না।’
বাংলা কাগজ অন্তত দেড় বছর অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে এর দুটোই করছে এজেন্টরা। এক্ষেত্রে রাজধানি ঢাকা এবং কুমিল্লার শতকরা ৯৪ শতাংশ বিকাশ এজেন্টের কাছে বাড়তি অন্তত একটি করে ব্যক্তিগত বিকাশ অ্যাকাউন্ট রয়েছে মর্মে নিশ্চিত হয়েছে বাংলা কাগজ। যা ব্যবহৃত হচ্ছে এজেন্টের নম্বরে অর্থ প্রেরণেও। কিন্তু যা একজন এজেন্ট কোনোভাবেই করতে পারেন না। এতে কোনও ব্যক্তির বিকাশ হিসাব না থাকলেও তিনি অনায়াসেই এজেন্টের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করতে পারছেন। এক্ষেত্রে সন্দেহজনক কোনও লেনদেন চললেও, সেটি ধরার উপায় থাকছে না।
এমনক্ষেত্রে ৮৭ শতাংশ বিকাশ এজেন্টের কাছে রয়েছে অন্তত ২টি করে বিকাশের বাড়তি ব্যক্তিগত হিসাব।
আর ৮৪ শতাংশের কম তবে ৭৬ শতাংশের বেশি এমন বিকাশ এজেন্টদের কাছে অন্তত ৩টি করে বিকাশের ব্যক্তিগত হিসাব।
অনুসন্ধানে বাংলা কাগজ আরও দেখেছে, কোনও এজেন্টই গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের হিসাব রয়েছে কি-না, তা যাচাই করছে না।
যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ব্যাপারে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘তাহলে তো সন্দেহজনক লেনদেন ঠেকানো যাবে না।’
বাংলা কাগজ অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক গত দেড় বছরে ঢাকা বা কুমিল্লায় (এ প্রতিবেদনের জন্য বাংলা কাগজের অনুসন্ধান এলাকা হিসেবে ব্যবহৃত) মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত কোনও অভিযান পরিচালনা করে নি।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘এমনটি হওয়া উচিত নয়।’
গ্রাহক সেবায় গুড়েবালি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন এখানেও : ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর জারি করা পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের ‘মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এর পরিষেবাসমূহের ধরণ ও সার্ভিস চার্জ/মাসুল সম্পর্কে গ্রাহকগণকে যথাযথভাবে অবহিতকরণ প্রসঙ্গে’ শিরোনামের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘(১) যে কোনও পরিষেবা প্রদানের পূর্বে পরিষেবার ধরণ, পরিষেবার জন্য প্রযোজ্য সার্ভিস চার্জ/মাসুল এর পরিমাণ এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জের তালিকা (Schedule of Charges) এবং Frequently Asked Question (FAQ) প্রস্তুতকরতঃ সে সম্পর্কে গ্রাহকগণকে যথাযথভাবে অবহিত করার উদ্দেশে সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ্লিকেশনে প্রদর্শন করতে হবে;
(২) পরিষেবার ধরণ বা সার্ভিস চার্জ/মাসুল হার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গ্রাহকগণকে অগ্রিম নোটিফিকেশন প্রেরণের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে;
(৩) সার্ভিস চার্জ/মাসুল হার সংক্রান্ত বিভ্রান্তি পরিহারকল্পে বিভিন্ন গণযোগাযোগ (সংবাদপত্র, পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, ইউটিউব চ্যানেল ইত্যাদি) এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন ইত্যাদি) প্রচার প্রচারণাসহ সকল ক্ষেত্রে ভ্যাটসহ সার্ভিস চার্জ/মাসুল হার উল্লেখ করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত অন্তত এক সপ্তাহ ধরে গ্রাহক থেকে গ্রাহকে অ্যাপস বাদে ম্যানুয়ালি অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে (সেন্ড মানি) বিকাশ প্রতিবার চার্জ কাটছে ১০ টাকা করে। অথচ এ চার্জ ছিলো ৫ টাকা। আর বিকাশ অ্যাপের ক্ষেত্রে এমন মাধ্যমে অর্থাৎ সেন্ড মানিতে কোনও চার্জই কাটা হয় না। অথচ যেসব মানুষ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন না কিংবা পাসওয়ার্ড চুরিসহ নানা ঝক্কি এড়াতে যাঁরা ম্যানুয়াল পদ্ধতিকেই বাছাই করে নেন; তাঁরা পড়েছেন বিপাকে। কারণ তাঁদের জন্য সেন্ড মানি খরচ হয়ে গেছে দ্বিগুণ (৫ টাকা থেকে ১০ টাকা)। এমনক্ষেত্রে গ্রামিণ জনগোষ্ঠির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে চার্জ বাড়ালেও কোনও নোটিফিকেশন দেয় নি বিকাশ। যেখানে বাংলা কাগজ পরিবারের অন্তত ৪টি বিকাশ হিসাব রয়েছে; অথচ সেগুলোর কোনোটিতেই চার্জ বাড়ানো বা পরিবর্তনের ব্যাপারে আগাম কোনও বার্তা বা নোটিফিকেশনই আসে নি।
এ ব্যাপারে অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য আরও অন্তত ৪ জন গ্রাহকের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চায় বাংলা কাগজ। তাঁদের প্রত্যেকেই জানিয়েছেন, কেউই বিকাশের চার্জ বাড়ানোর বিষয়টি সম্পর্কে আগাম বার্তা পান নি। একই বিষয় গণমাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশের কথা থাকলেও এটি কোথাও প্রচার বা প্রকাশ করা হয় নি বলেই বাংলা কাগজকে নিশ্চিত করেছেন অন্তত ৪৭ জন বিকাশের গ্রাহক।
পাশাপাশি এটি বিকাশের অ্যাপে বা ওয়েবসাইটে প্রকাশের কথা থাকলেও ৯ মার্চ, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ রাত ৭টা ৪৮ মিনিট পর্যন্ত সেটি কোনও মাধ্যমেই করে প্রকাশ করে নি বিকাশ।
নোটিফিকেশন না জানিয়ে চার্জ বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা কাগজকে বলেন, ‘এটা তো হতে পারে না। গ্রাহককে অবশ্যই আগে জানানো উচিত ছিলো। আর ক্যাশ আউট চার্জ হাজারে প্রায় ২০ টাকা (১৮ টাকা ৫০ পয়সা) দিস ইজ ঠু মাচ।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য : সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহি পরিচালক সিরাজুল ইসলাম মুঠোফোনে বাংলা কাগজকে বলেন, ‘আমার কথা হলো গিয়ে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক যে সমস্ত সার্কুলার দিয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে, এ নির্দেশনা যদি কেউ পরিপালন না করে বা এ নির্দেশনার যদি কেউ ব্যত্যয় ঘটায় এবং সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নোটিশে আসলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বিকাশের বক্তব্য : বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা না মানার ব্যাপারে মুঠোফোন থেকে কল করা হলেও সেটি রিসিভ করেন নি বিকাশের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা কামাল এইচ কাদির। পরে তাঁকে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তাতেও নিরুত্তর থাকেন কামাল।